Tuesday, June 11, 2024

কাউনিয়ায় ভুয়া বিল-ভাউচারে এতিমখানার বরাদ্দের টাকা উত্তোলন


নিজস্ব প্রতিবেদক 
রংপুরের কাউনিয়ায় আল আমিন শিশু সদনের অনুমোদনহীন কমিটির স্বাক্ষরে ভুয়া বিল-ভাউচারে এতিমদের বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে এবার উপজেলা সমাজসেবা অফিসারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ওই এতিমখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এতিমের টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। তবে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার জানায়, টাকা উত্তোলন করে অফিসিয়াল একাউন্টে জমা রাখা হয়েছে। এখানো ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের হিসেবে হস্তান্তর করা হয়নি।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে আল আমিন শিশু সদন এতিমখানার ৫৮ জন এতিম শিশুর জন্য (জুলাই- ডিসেম্বর) ১ম কিস্তির লাখ ৯৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। নিয়ম রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়ে বেসরকারি এতিমখানা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কমিটির স্বাক্ষরীত নিবাসী এতিমদের তালিকা ব্যয়ের বিল ভাউচার দাখিল করবে।

সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তা ওই এতিমখানার নিবাসী এতিম শিশুর সংখ্যা, কমিটির মেয়াদ যাচাই-বাছাই করে এতিম শিশুর খাওয়া, পোশাক চিকিৎসার ব্যয় বিল-ভাউচার অনুমোদন দিবেন। অথচ গত ১৯ ফেব্রুয়ারী আল আমিন শিশু সদনের কার্যকারী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। আর নতুন কার্যকারী কমিটির অনুমোদন দেয় জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সুত্র জানায়, এখনো ওই এতিমখানার নতুন কার্যকারী কমিটির অনুমোদন হয়নি। অথচ সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অনুমোদনহীন কার্যকারী কমিটি তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষরীত ব্যয় বিল-ভাউচার অনুমোদন করে এতিম শিশুর জন্য ষানমাসিক বরাদ্দ বাবদ লাখ ৯৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিউল ইসলাম।

উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় সুত্র জানায়, জুন উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে ওই এতিমখানার নিবাসী এতিমদের বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের জন্য কার্যকারী কমিটির রেজুলেশন, কর্মকর্তার প্রত্যায়নপত্রসহ অনুমোদন করা ব্যয় বিল-ভাউচার দাখিল করা হয়। জুন যাচাই-বাছাই করে সরকারি কোষাগার থেকে সেই টাকা উপজেলা সমাজসেবার অফিসিলায় ব্যাংকের হিসেবে হস্তান্তর করা হয়েছে।

জানা যায়, নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি এতিমখানায় অবস্থানরত এতিমের মোট সংখ্যার সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ডের জন্য বিবেচিত হবে। গ্র্যান্ডপ্রাপ্তির শর্ত মোতাবেক চলতি অর্থবছর আল আমিন শিশু সদন এতিমখানায় ৫৮ জন এতিম নিবাসীর জন্য মোট এতিম থাকতে হবে ১১৬ জন।

স্থানীয়রা জানায়, এতিমখানাটিতে থেকে ১০ জন এতিম দুস্থ শিশু রয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরে সেখানে অতিরিক্ত ভুয়া নিবাসী এতিম শিশু দেখিয়ে লাখ ৯৬ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ২০২২-২০২৩ইং অর্থবছর অতিরিক্ত ভুয়া এতিম শিশু দেখিয়ে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে এতিমখানা র্কর্তৃপক্ষ।

সমাজসেবা কর্মকর্তার পরোক্ষ সহযোগিতায় বছরের পর বছর ধরে অর্ধশত অতিরিক্ত ভুয়া এতিম শিশু দেখিয়ে সরকারি অর্থ উত্তোলন করেছে কর্তৃপক্ষ। আর এতিমদের বরাদ্দের বেশীরভাগ টাকা লোপাট করেছে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ।

ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদপ্তর রংপুরের উপ-পরিচালক বরাবরে এতিমখানা র্কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এতিমদের টাকা লোপাটের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন আব্দুর গফুর নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। এছাড়াও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে একই লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।

তবে এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা ছমির উদ্দিন অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, গতবছর এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু ছিল। ওই বছর আগস্টে সমাজসেবা কর্মকর্তা স্বাক্ষরীত প্রত্যায়নপত্র আছে। নীতিমালা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড প্রাপ্ত ৫৮ জন এতিম শিশুর তালিকা ব্যয় বিল-ভাউচার উপজেলা কার্যালয়ে দাখিল করেছেন।

অতিরিক্ত এতিম দেখিয়ে অর্থের অনিয়ম যদি হয়ে থাকে তার দায়ভার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার। কারণ ওই কর্মকর্তা প্রতিবছর পরিদর্শন করে এতিমখানায় নিবাসী শিশুর সংখ্যার প্রত্যায়নপত্র দিয়েছেন। যার ভিত্তিতে এতিম শিশুর জন্য বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

মাওলানা ছমির উদ্দিন আরো বলেন, গত ফেব্রুয়ারীতে কমিটির মেয়াদ শেষ হলে, নতুন কমিটি জমা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটির কাগজ বাতিল করে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা তাঁর ব্যক্তিগত লোককে সভাপতি করে কমিটি গঠন করে। কমিটি এখনো অনুমোদন হয় নাই।

আগের জমা করা কাজগপত্র বাতিল করে আবারও ব্যয় বিল-ভাউচার তৈরী করা হয়। সেই বিল ভাউচারে অনুমোদনহীন কমিটি স্বাক্ষর করে এবং উপজেলা কর্মকর্তা অনুমোদন দিয়ে টাকাও উত্তোলন করেছে।

এদিকে এতিমখানার সাবেক সভাপতি শাহেনুর আলম বলেন, অর্থের অভাবে গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে এতিমখানাটি বন্ধ রয়েছে। শুনেছি অতিরিক্ত এতিম শিশু দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে অভিযোগ হয়েছে। যদি এতিমের বরাদ্দের অর্থ লোপাট হয়ে থাকে এর দায়ভায় এতিমখানার তত্ত্বাবধায়কের এবং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার।

কমিটি এর দায়ভার নিবে না। কারণ গতবছর এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার প্রত্যায়নপত্র উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা দিয়েছেন। তিনি যদি প্রত্যায়নপত্র না দিতেন তাহলে অতিরিক্ত এতিম শিশু দেখানোর সুযোগ থাকতো না তত্ত্বাবধায়কের।

উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সামিউল ইসলাম বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে অল্প সংখ্যক হলেও এতিম দুস্থ শিশু খাওয়া দাওয়া করে। বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা না হলে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিভিন্নজনের সুপারিশে ১ম কিস্তির বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে হস্তান্তর করা হয়নি। অনুমোদনহীন কমিটির স্বাক্ষরে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার প্রত্যায়নপত্র দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তর রংপুরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, আল আমিন শিশু সনদ এতিমখানার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভুয়া এতিম সাজিয়ে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি গত ১৭ মার্চ তদন্ত করেছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গিয়েছে।

ওই প্রতিষ্ঠানে চলতি অর্থবছর বরাদ্দের টাকা ছাড় না করার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে বলা হয়েছে। শুনেছি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এখানো প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয় নাই। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার যে প্রত্যায়নপত্র কিভাবে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট অফিসার বলতে পারবে। সার্বিক বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।

এতিমের বরাদ্দ লোপাটের বিষয়টি রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসানের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ওই এতিমখানায় কোনো এতিম শিশু নেই বলে তিনি জানতে পেরেছেন। ইতিপুর্বে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় কমিশনার স্যারের বরাবরে টিআর/জিআর এর জন্য আবেদন করলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে খোঁজ নিতে বলা হয়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার খোঁজ নিয়ে কোনো এতিম শিশু না পাওয়ায় প্রতিবেদন দিলে টিআর/জিআর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, এতিমের বরাদ্দ লোপাটসহ সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমআর

No comments:

Post a Comment